প্রতিনিধি ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৫:১১:১২ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নুরুল কবিরের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক হেনস্তা ও হামলার ঘটনা দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিকের ওপর শারীরিক ও মানসিক আক্রমণ কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়—এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা,গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।

একটি সমাজ যখন নিজেকে সভ্য ও একটি রাষ্ট্র যখন সংবিধানসম্মতভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়, তখন সেই রাষ্ট্রের ভেতরেই একজন সাংবাদিক হামলার শিকার হওয়া আমাদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। এই প্রশ্ন আজ শুধু একজন সাংবাদিককে ঘিরে নয়; এটি সত্য উচ্চারণের অধিকার,জনস্বার্থে প্রশ্ন তোলার স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে।
সাংবাদিকরা কেবল খবর লেখেন না—তারা সময়ের সাক্ষী। তারা অন্ধকারে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেন,শক্তের বিরুদ্ধে দুর্বলের কণ্ঠ হয়ে দাঁড়ান এবং ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তোলেন।এই প্রশ্ন অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হলেও,গণতন্ত্রের শ্বাসপ্রশ্বাস এই প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত।কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,সত্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ হলেও সেই পথেই হাঁটতে হয়; আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দেন—যেখানে ভয় আছে, সেখানে মুক্তি নেই।
নুরুল কবির দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় গড়া এক দৃঢ় সাংবাদিক সত্তা।তাঁর লেখনীতে ছিল যুক্তি,কণ্ঠে ছিল প্রশ্ন এবং অবস্থানে ছিল অনড়তা।এই দৃঢ়তার ওপর আঘাত মানে শুধু একজন মানুষকে আঘাত করা নয়; বরং সমাজে একটি ভীতিকর বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া—যেন সত্য বলা বিপজ্জনক এবং প্রশ্ন তোলা ঝুঁকিপূর্ণ। এই বার্তা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে আগামী দিনে আর কোনো কণ্ঠই নিরাপদ থাকবে না।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষ বিবরণ অনুযায়ী,পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নুরুল কবির শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রমণের শিকার হন।রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব—বিশেষ করে যারা জনস্বার্থে কাজ করেন এবং সত্য উন্মোচনে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু বাস্তবতায় হামলাকারীরা এখনো শনাক্ত বা আইনের আওতায় আসেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।এই অনিশ্চয়তা ও নীরবতা অপরাধকে উৎসাহিত করে এবং ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,ন্যায় যেখানে অনুপস্থিত,সেখানে শক্তিই রাজা হয়ে বসে।এই ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত না হলে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে, আইনের শাসনের ওপর আস্থা আরও ক্ষুণ্ন হবে। তখন সংবিধান থাকবে কাগজে,আইন থাকবে বইয়ের পাতায়—বাস্তবে চলবে ভয় ও দম্ভের শাসন।
এ ঘটনায় নীরবতা কোনো সমাধান নয়।নীরবতা মানে সম্মতি, নীরবতা মানে অপরাধীর পাশে দাঁড়ানো।তাই নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কণ্ঠ তুলে ধরা জরুরি। হামলার সুষ্ঠু তদন্ত, দ্রুত বিচার এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কোনো দয়া নয়—এটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে না।সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ।সেই দর্পণে আঘাত মানে সমাজের নিজের মুখ দেখার সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আত্মসমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে—আমরা কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি,নাকি সুবিধাজনক নীরবতায় আশ্রয় নিচ্ছি? ইতিহাস বলে,নীরবতা কখনো ক্ষমা পায় না; প্রতিবাদই পরিবর্তনের পথ দেখায়।
সাংবাদিক নুরুল কবিরের ওপর হামলার সুষ্ঠু তদন্ত,দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হচ্ছে।কোনো অজুহাত,কোনো বিলম্ব বা রাজনৈতিক হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এখানে প্রশ্ন একজন সাংবাদিকের নিরাপত্তা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজের চরিত্র নিয়ে।
আজ নুরুল কবিরের পাশে দাঁড়ানো মানে আগামী দিনের সত্যের পাশে দাঁড়ানো।এই দায় ও দায়িত্ব সবার।ন্যায়বিচারই একমাত্র উত্তর, জবাবদিহিই একমাত্র পথ—এই পথেই আমাদের এগোতে হবে।

















