শিক্ষা

শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে নরওয়ে যাচ্ছেন—এ খবর পেয়ে মা খুব খুশি হয়েছেন-সুরভী

  প্রতিনিধি ৩ জুন ২০২৩ , ১২:০৫:১৬ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে নরওয়ে যাচ্ছেন—এ খবর পেয়ে মা খুব খুশি হয়েছেন জানিয়ে সুরভী বলেন, ‘মা খুব খুশি হয়েছেন।মা বলেছেন, তিনি যখন আমার কথা ভাবেন, তখন নাকি তাঁর মন ভালো হয়ে যায়।জীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।’আমার ১৭ দিন বয়স থেকে মা আমাকে কোলে নিয়ে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে ব্র্যাকের স্কুলে যেতেন।স্কুলের বারান্দায় আমাকে শুইয়ে রেখে শিক্ষার্থীদের পড়াতেন।অনেক সময় নাকি আমাকে পিঁপড়া কামড়াত।তিনবেলা খাবার জুটত না।নিজেদের থাকার জায়গা ছিল না বলে কিছুদিন চাচার কাছে,আবার কিছুদিন মামার বাড়ি থেকেছি।ঈদের আগের রাতে নতুন জামার কান্নাকাটি করতাম।একটু বড় হয়ে বুঝতে শিখলাম,এই অবস্থা থেকে আমাকে বের হতেই হবে’, কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সুরভী আক্তার।

দারিদ্র্য থেকে বের হওয়ার অদম্য এই জেদ সুরভীকে আজ এত দূর নিয়ে এসেছে।পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কেয়ার প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমের অধীন গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে আগামী আগস্টে নরওয়ের এগদার ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার জন্য যাওয়ার কথা তাঁর।

সুরভী জানালেন,এখনো থাকার জন্য আছে শুধু একটা ছাপরা ঘর।ঝড়-বৃষ্টিতে চুলা ভিজে যায় বলে রান্নাও বন্ধ থাকে।বন্যায় ঘরে পানি ওঠে।সাপ,পোকামাকড় ঢুকে যায় ঘরে।

তবে এ অবস্থা আর বেশি দিন থাকবে না উল্লেখ করে আত্মবিশ্বাসী সুরভী বলেন, নরওয়ের এগদার বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পরিচালিত কেয়ার প্রকল্পের আওতায় ভিন্ন দুই মেয়াদে এই শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ পাচ্ছেন তিনিসহ অন্য শিক্ষার্থীরা।চলতি বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নরওয়েতে থাকবেন।যাতায়াতের জন্য উড়োজাহাজের টিকিট,থাকা-খাওয়ার খরচের পাশাপাশি প্রতি মাসে হাত খরচও দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।তবে ভিসা-সংক্রান্ত কাজে যে খরচ হবে,তা হয়তো নিজেকে দিতে হবে।

নরওয়েতে গিয়ে ভালো ফলাফল করতে পারলে তা সুরভীর জীবনের একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম।তিনি বলেন,সেখানেই উচ্চতর সে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে।

গবেষণায় সুরভীর আগ্রহ প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন,সুরভী গবেষণায় তাঁর আগ্রহের কথা জানায়।তবে একদিন জানিয়ে চুপ করে বসে ছিল,তা নয়।প্রতিনিয়ত আগ্রহের কথা জানিয়েছে,অর্থাৎ লেগে ছিল।গবেষণা সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে কখনোই সে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা জানায়নি।এ দিকটি আমার খুব ভালো লেগেছে।সে তার আর্থিক দুরবস্থার কথা জানিয়ে বাড়তি কোনো সুযোগ নিতে চায়নি।’সুরভী তাঁর পরীক্ষার ফলাফল ও অন্যান্য যোগ্যতায় বৃত্তিটি পেয়েছে বলে জানান তিনি।

গত বুধবার সুরভীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।তিনি জানালেন,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকেন। গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করে যে সম্মানী পান,তা থেকেই মা রেহানা বেগম,বাবা আতিয়ার রহমান ও ভাইকে কিছুটা সাহায্য করার চেষ্টা করেন।বাবা কর্মক্ষম নন,তাই মাকে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাকের স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতে হয়েছে।ভাই বিয়ে করেছেন।করোনার সময় ব্যবসা করতে গিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেননি। তাই এই ঋণের টাকা পরিশোধেও সুরভীকে মাঝেমধ্যে সাহায্য করতে হচ্ছে।ফলে এখনো সুরভী নিজে বা তাঁর পরিবার সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি।তবে সেই ছোটবেলার চেয়ে অনেকটাই ভালো আছেন তাঁরা।তিনবেলা খেতে পারছেন।ঈদে নিজের মা-বাবার জন্য নতুন পোশাক কিনতে পারছেন।মা পাটখড়ির যে ছাপরা ঘর করেছিলেন,তাতেই থাকতে হচ্ছে এখনো।

জীবনের এ পর্যন্ত আসার পেছনে শিক্ষকদের সহায়তা পেয়েছেন।আর পাশে পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক–প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিলকেও।এ তহবিলের মাধ্যমে এইচএসসি ও স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন তিনি।এ ছাড়া পাশে পেয়েছেন ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন,বর্ণ কোচিং সেন্টার, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মতো কিছু সংস্থাকে। বরাবরের মতোই সুরভী ভালো ফলাফল করে চলেছেন।

সুরভী বললেন, ‘যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম, অধ্যাপক সজল চন্দ্র বণিক,একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা বড় ভাই জসিম উদ্দিন, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের চন্দ্র নাথ,ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের সাইফুর রহমানসহ এমন অনেক মানুষের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।এ ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রতিও কৃতজ্ঞ আমি।তাঁরা আমার পাশে না থাকলে আমি এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।’

এসএসসি পরীক্ষার সময় বিদ্যুৎ বিল দিতে না পারায় বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে সুরভী জানালেন,হারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে।তবে সব সময় মনে হয়েছে,যে করেই হোক মায়ের কষ্ট দূর করতেই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।

হার না মানা এই শিক্ষার্থী আরও বলেন,আমি সব সময় ভালো কাজ করতে চাই।আমি চাই,আমাকে দেখে হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনুপ্রাণিত হোক,কখনো তারা হার না মানুক।’

ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ঢাকায় এসে সুরভী বর্ণ কোচিং সেন্টারে বিনা মূল্যে থাকা,খাওয়া ও কোচিং করার সুযোগ পেয়েছিলেন।এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তারপর সুরভীর পাশে এসে দাঁড়ায় মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। সুরভীর করোনা হয়েছিল।করোনা-পরবর্তী জটিলতায় সুরভীর এক চোখে কালো কালো দাগ ছড়িয়ে পড়ে।সেই চোখে তখন দেখতেই পাচ্ছিলেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের চন্দ্র নাথ তাঁর চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন।প্রথমে ঢাকা ও পরে ভারতে চোখের চিকিৎসা করার সুযোগ পান সুরভী।তবে এখনো এক চোখে ঝাপসা দেখেন।প্রথম দিকে বিষয়টি মেনে নিতে না পারলেও এখন মানিয়ে নিয়েছেন বলে জানালেন সুরভী।কেননা,কোনো কারণেই পেছনে পড়ে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধন করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চন্দ্র নাথ।তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। দেশটির মেকার করপোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রযুক্তিবিষয়ক কর্মকর্তাও (সিটিও) তিনি।পাশাপাশি ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পারডু ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন চন্দ্র নাথ।সুরভীর নরওয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে চন্দ্র নাথ ফেসবুকে সুরভীকে ফাউন্ডেশনের ‘হিরো’ ও ‘স্কলার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে অভিহিত করে পোস্ট দিয়েছেন।

সুরভী সম্পর্কে চন্দ্র নাথ ফেসবুকে লিখেছেন,সুরভীর পরিবারের আয় বলতে কিছুই নেই।তবে সুরভী পড়াশোনাটা চালিয়ে গেছেন এবং ভালো ফলাফল করেছেন।তাঁকে ফাউন্ডেশন যতটুকু সহায়তা দিয়েছে,তার থেকে তিনি ফাউন্ডেশনকে বেশি ফিরিয়ে দিয়েছেন।সুরভী হলেন ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম শিক্ষার্থী,যিনি বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন গবেষণার জন্য।সুরভী দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাসিক বৃত্তি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

সুরভীর শিক্ষক অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম এবং মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট চন্দ্র নাথ পরস্পর বন্ধু।

অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম বলেন,সুরভী গবেষণা সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগপর্যন্ত মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বা চন্দ্র নাথের কথা জানায়নি।এটিও আমার খুব ভালো লেগেছে।সুরভীর যে আর্থিক অবস্থার কথা পরে জেনেছি,তাতে মনে হয়েছে,কেউ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে,তা করা সম্ভব।সুরভী এখন পর্যন্ত তা করে দেখিয়েছে।’

আরও খবর

Sponsered content