কৃষি সংবাদ

তেলবীজের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা অর্ধেকে আনতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করছে সরকার

  প্রতিনিধি ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ , ৩:৪০:০০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।দেশে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর।এতে বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।আমদানিতে এগিয়ে সয়াবিন ও পাম অয়েল।দেশে উৎপাদিত তেলের মধ্যে শীর্ষে সরিষা।এছাড়া সয়াবিন,সূর্যমুখীসহ দু-একটি অপ্রচলিত তেলবীজের চাষ হয় সামান্য।বোরো,আমন চাষের মাঝের সময়ে বড় অংশ জমি পতিত থাকে।এ পতিত জমি ব্যবহারসহ দেশে তেলবীজের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা অর্ধেকে আনতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করছে সরকার।

রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশ কিছু তেলজাতীয় ফসলের সঙ্গে সরিষার আবাদ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।মিলতে শুরু করেছে তার সুফলও।এ বছর সারাদেশে ব্যাপকভাবে বেড়েছে সরিষার চাষাবাদ।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে,গত বছর সারাদেশে ছয় লাখ ১০৬ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছিল।উৎপাদন ছিল ৮ লাখ ২৪ হাজার টন।চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৬ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল।তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এ বছর আবাদ হয়েছে আট লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে।উৎপাদন সাড়ে ৯ লাখ টন ছাড়াতে পারে বলেও আশা করা হচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ষবৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতার কারণে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারও গত বছর থেকে বেশি অস্থিতিশীল।ভোক্তারা তেল কিনেছেন রেকর্ড দামে।সেটার একটি প্রভাব পড়েছে সরিষা চাষে।গত এক বছরের তুলনায় সরিষা বীজের দাম প্রতি মণে বেড়েছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা।সে কারণেও চাষিরা সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন।

২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসল আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।এর মধ্যে সরিষার তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা সাড়ে ২৬ লাখ টন।

এ প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে দেশের ২৫০ উপেজলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২২২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।গত বছর তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে ৫শ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয় সরকার।

তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নেওয়া প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিন বলেন,পাঁচটি তেলজাতীয় ফসল সরিষা,সূর্যমুখী,সয়াবিন,চিনাবাদাম ও তিলের উৎপাদন বাড়াতে কাজ চলছে।এ বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা, ৭০ হাজার বিঘা জমিতে সূর্যমুখী,২৬ হাজার বিঘা জমিতে চিনাবাদাম এবং ২৪ হাজার বিঘা জমিতে সয়াবিন চাষে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

শুধু প্রকল্প নয়, উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি),বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি),বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও (বিনা) কাজ করছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী,দেশে ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ও বোরো চাষ হয়।দুই ধান চাষের মাঝখানের মৌসুমে প্রায় দুই মাস ২০ লাখ হেক্টর জমি পতিত থেকে যায়। সেগুলোতে সরিষা ও অন্য তেলজাতীয় বিভিন্ন ফসলে আগ্রহী করতে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বিনা।এ বছর এ দুই ফসলের মধ্যে প্রচুর এলাকায় সরিষা চাষ হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে।

জানা যায়,চাষ বাড়াতে সরিষা,সূর্যমুখী ও চিনাবাদামের দুই হাজার টনের বেশি বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছিল চলতি মৌসুমে।পাশাপাশি দেওয়া হয় নারিকেলের চারা।

গত বছর প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোগাপাড়া গ্রামের কৃষক লোকমান হোসেন।উচ্চ ফলনশীল বিনা জাতের সরিষার ফলন পেয়েছিলেন বিঘাপ্রতি সাত মণেরও বেশি।সে সময় বাজারে ভালো দাম পাওয়ার কারণে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা লাভ করেন তিনি।এ বছর আরও লাভের আশায় পাশের দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়ে সাড়ে পাঁচ বিঘায় সরিষা আবাদ করেছেন।

লোকমান বলেন,বাজার ভালো থাকায় প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করা যায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে। এবার দাম আরও বেশি হবে বলে আশা করছি।এত অল্প সময়ে অন্য ফসলে এত লাভ হয় না।সরিষা আবাদে সেচের প্রয়োজনও কম।আবার বীজের কোনো সমস্যা হয়নি। বিনামূল্যে বেশ কিছু বীজ পেয়েছি।সব মিলিয়ে কম খরচে বেশি লাভের জন্য সরিষা এখন সেরা।

বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি,সরিষার ভালো দাম পাওয়া, উন্নত জাতের কারণে স্বল্পসময়ে অধিক ফলন,কম খরচ ও অল্প পরিশ্রমে ফসল পাওয়ায় এখন সরিষা চাষে বেশ আগ্রহী টাঙ্গাইলের অধিকাংশ কৃষক।এজন্য দেশের সরিষা উৎপাদনের অন্যতম জেলা এটি।

টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন হলুদ রঙের সরিষা ফুলের সমারোহ।সরিষার আবাদের পাশেই মৌ চাষের প্রচলনও বেড়েছে।মাঠের পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন।ফলে সরিষাচাষি ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হওয়ায় টাঙ্গাইলে সরিষা চাষ বেড়েছে।তবে শুধু টাঙ্গাইল নয়,দেশের অধিকাংশ এলাকায় এখন সরিষার আবাদ বেড়েছে।

সয়াবিন ও পাম তেলের দাম দ্রুত বাড়ায় দেশে সরিষার তেলের চাহিদা বেড়েছে।এছাড়া স্বাস্থ্য সচেতন অনেক মানুষ এখন সরিষার তেল বেছে নিচ্ছেন।একইভাবে বাজারে চাহিদা বেড়েছে চালের কুঁড়া থেকে তৈরি রাইসব্রান অয়েল ও সূর্যমুখীর তেলের।

কারওয়ান বাজারে দীর্ঘদিন ধরে তেলের ব্যবসা করছেন সোনালি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম।তিনি বলেন, আগে তো সয়াবিন ছিল না।তখন শুধু সরিষার তেল খেয়েছে মানুষ। এখন পর্যাপ্ত পাওয়া গেলে সরিষার তেলই খাবে।

তিনি বলেন,মাঝে সরিষার জনপ্রিয়তায় ভাটা ছিল।কিন্তু গত দুই বছরে দফায় দফায় সয়াবিন তেলের দাম বাড়ায় অনেকে সরিষার তেল খাচ্ছেন।দিন যত যাচ্ছে সে সংখ্যা বাড়ছে। যদিও এর মধ্যে সরিষার তেলের দামও কয়েক দফা বেড়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী,দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে।এর মধ্যে ১৮ লাখ টনের চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করে।আমদানির মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল প্রায় পাঁচ লাখ টন।সয়াবিন বীজ আমদানি হয় প্রায় ২৪ লাখ টন,যা থেকে চার লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়।আর ১১ লাখ টন অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে,সব মিলিয়ে স্থানীয়ভাবে ভোজ্যতেলের উৎপাদন দুই থেকে আড়াই লাখ টন।এর মধ্যে সরিষা,সূর্যমুখীসহ অন্য ভোজ্যতেল রয়েছে।

সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউয়ে বলা হয়েছিল,ঘাটতি তেল আমদানি করতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশকে সব মিলিয়ে ১১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার।অর্থাৎ,সেই হিসাবে গত কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যে হারে বেড়েছে,তাতে খরচ দুইশ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

নব্বইয়ের দশকে এসে বাজারের বড় অংশ দখলে নেয় সয়াবিন তেল।এখন সরিষাকে কোণঠাসা করে সয়াবিন তেলের একচেটিয়া রাজত্ব।এর মধ্যে সূর্যমুখীর তেল বা চালের কুঁড়ার রাইসব্রান অয়েলের মতো অনেক কিছুই বিকল্প হিসেবে বাজারে এসেছে।কিন্তু শেষমেশ কোনোটিই হালে পানি পায়নি। সয়াবিনেই আস্থা রাখতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

চাহিদার তুলনায় উৎপাদন নগণ্য বলে বাজারে এখন সরিষার তেলের দাম আরও বেশি,যা সয়াবিনের দ্রুত জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ।বাজারে অবশ্য এখনো সরিষার তেলের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম কম।ফলে সরিষার তেলের উৎপাদন বড় পরিসরে বাড়ানো সম্ভব না হলে এখন সয়াবিনের বাজার ধরা সম্ভব নয়।

দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিকল্প তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে এসব সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান।তিনি বলেন,পুষ্টিচাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে দেশে তেল উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া বাজারে ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেট,সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা বলতে আমরা যা শুনি,সেগুলো কমবে নিজের উৎপাদিত তেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হলে।

তিনি বলেন,সরকারের উচিত তেলচাষিদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়া।তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে উৎপাদিত তেল সংরক্ষণ ও বিপণনের।এছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে তেলবীজ চাষের জমি সম্প্রসারণ করতে হবে।

রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদনে কার্যক্রম জোরদার করার জন্যও ওই তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত একীভূত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করারও সিদ্ধান্ত নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।

২০১২ সালে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে দেশে যাত্রা শুরু করে চালের কুঁড়া থেকে উৎপাদিত এ ভোজ্যতেল।কিন্তু এক দশকের ব্যবধানে এই তেল সুবিধা করতে পারেনি।মাঝে চাহিদা কিছুটা বাড়লেও অন্য তেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে রাইস ব্রান অয়েল।এখন লোকসানে পিছু হটতে শুরু করেছেন এই তেলের বাণিজ্যিক উৎপাদকরা।

শুরুতে কয়েক বছরের মধ্যে গোটা দশেক প্রতিষ্ঠান রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন শুরু করেছিল।শেষ পর্যন্ত দুই ডজন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।মাঝে সয়াবিনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে যাওয়া এই তেল নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে এক নম্বরের আসনটি দখল করে নেওয়ারও সম্ভাবনার কথা বলেন অনেকে।কিন্তু এখন ব্যবসা করতে পারছে না কেউই।সয়াবিনের চেয়ে চড়া দাম, চালের কুঁড়া সংগ্রহে সমস্যা,স্বাদে কিছুটা ব্যতিক্রম ও প্রচার-প্রচারণার অভাবে থমকে গেছে রাইস ব্রান অয়েলের বাজার।

জলপাই ও কার্পাস তুলার বীজ থেকে তেল উৎপাদন করা হয়।তবে এগুলোর চল বা ব্যবহার খুব সীমিত।এরমধ্যে দেশের কোথাও কোথাও জলপাইয়ের তেল তৈরি হলেও বাজারে বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জলপাইয়ের তেল বিক্রি হচ্ছে দেদারছে।এই তেলের দামও বেশ চড়া।স্বাস্থ্য সচেতন ও সামর্থ্যবানরাই এর ক্রেতা।

এছাড়া কার্পাস তুলার বীজ থেকে তেল উৎপাদনের জন্য কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে।এই তেল পরিশোধন করে খাওয়ার উপযোগী করার জন্য রয়েছে আলাদা একটি কারখানা।সেখানে বছরে প্রায় ৫শ টন তেল উৎপাদন হয়। কিন্তু দেশে তুলার মোট উৎপাদন কম হওয়ায় ব্যতিক্রমী এই ভোজ্যতেলকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে সমৃদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

ভোজ্যতেল উৎপাদন নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন,দেশে ৫০ শতাংশ তেল উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমাতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।এর মধ্যে আমরা প্রথম বছরই সারাদেশে দ্বিগুণ সরিষা চাষ করেছি।এরই মধ্যে রোডম্যাপের সফলতা দৃশ্যমান।আগামী দুই বছরের মধ্যে সরিষার আবাদ আরও বাড়ানোর সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে হবে।যাতে দুই বছর পরে ভোজ্যতেল আমদানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা যায়।

আরও খবর

Sponsered content