অপরাধ-আইন-আদালত

ছয় মিনিটের বৈঠক থেকে হত্যামিশন: শ্যুটার ফয়সালের ভয়ংকর নকশা

  প্রতিনিধি ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ , ১:১৩:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বিদেশ থেকে দেশে ফিরে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় একটি ‘শ্যুটার টিম’।টার্গেট বাস্তবায়নে আগে তৈরি করা হয় সখ্যতা,এরপর মাত্র সাত দিনের মধ্যেই চালানো হয় প্রাণঘাতী হামলা।গুলি করে হত্যার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই দেশ ছাড়ে মূল অভিযুক্ত ফয়সাল।পরিকল্পনা অনুযায়ী গায়েব করা হয় গুরুত্বপূর্ণ আলামতও।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার নেপথ্যে এমনই এক সুপরিকল্পিত মিশনের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে গোয়েন্দা তদন্তে।

কালচারাল সেন্টারেই শুরু সখ্যতা

ওসমান হাদি ও শ্যুটার ফয়সালের পরিচয় এবং সখ্যতার সূত্রপাত ঘটে ইনকিলাব মঞ্চের কালচারাল সেন্টারে।শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে—হাদিকে গুলি করার আগে শ্যুটাররা কোথায় কোথায় অনুসরণ করেছে এবং কীভাবে ধাপে ধাপে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।

গত ৪ ডিসেম্বর রাত ৮টা ১৮ মিনিটে বাংলামোটরের ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে আসেন ফয়সাল ও তার সহযোগী কবির।প্রায় ছয় মিনিটের বৈঠকটি ছিল মূলত হাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরির প্রথম ধাপ।ওই বৈঠকেই ফয়সাল হাদির সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন।

এরপর ৯ ডিসেম্বর রাতে আবারও কালচারাল সেন্টারে আসেন ফয়সাল।এবার তার সঙ্গে ছিলেন না কবির; নতুন সঙ্গী ছিলেন আলমগীর।আলোচনার বিষয় ছিল নির্বাচনী প্রচারণার পরিকল্পনা।সেখান থেকেই হাদির টিমে ঢুকে পড়েন ফয়সাল। পরদিন ১২ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় হাদির প্রচারণায় সরাসরি অংশ নেন তিনি।

রেকি থেকে হামলা

প্রচারণায় অংশ নেওয়ার পরই হাদিকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন ফয়সাল।মিশন বাস্তবায়নে নরসিংদী,সাভার, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় রেকি করা হয়।১১ ডিসেম্বর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওঠেন পশ্চিম আগারগাঁওয়ে বোনের বাসায়।হামলার দিন ভোরে উবারে করে যান হেমায়েতপুরের একটি রিসোর্টে।

রিসোর্টের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়,ভোর ৫টা ২২ মিনিটে ফয়সাল ও আলমগীরের গাড়ি গ্রিন জোন রিসোর্টে প্রবেশ করে।সেখানে আগে থেকেই ছিলেন ফয়সালের বান্ধবী মারিয়া ও তার বোন।সেখানে হাদির একটি ভিডিও দেখিয়ে ফয়সাল জানান,তিনি হাদির মাথায় গুলি করার পরিকল্পনা করেছেন এবং এতে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হবে।ঘটনার পর তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশও দেন তিনি।

সকাল ৮টা ৫৪ মিনিটে বান্ধবীকে নিয়ে রিসোর্ট ছাড়েন ফয়সাল।বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন আলমগীর।উবারে করে বান্ধবীকে বাড্ডায় নামিয়ে দিয়ে সকাল ১১টা ৫ মিনিটে আগারগাঁওয়ের বাসা থেকে মোটরসাইকেলে বের হন ফয়সাল ও আলমগীর। তারা সরাসরি যান হাদির সেগুনবাগিচার প্রচারণায়।

মুহূর্তে মুহূর্তে অনুসরণ

দুপুর ১২টা ২২ মিনিটে হাদি মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা হলে শ্যুটাররা তার অটোরিকশা অনুসরণ করতে থাকে।১২টা ৫০ মিনিটে হাদিকে বহনকারী অটোরিকশা মতিঝিলের জামিয়া দারুল উলুম মসজিদের সামনে পৌঁছায়।সেখানে জুমার নামাজ শেষে প্রচারণার প্রস্তুতি চলছিল।

দুপুর ২টা ১৬ মিনিটে হাদি সেখান থেকে রওনা হলে শ্যুটাররাও পিছু নেয়।মতিঝিল শাপলা চত্বর হয়ে দৈনিক বাংলা মোড় ঘুরে পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে ঢুকে পড়ে তারা। ফাঁকা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে দুপুর ২টা ২৪ মিনিটে খুব কাছ থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি ছোড়ে ফয়সাল।

পালানো ও আলামত গায়েব

হামলার পরপরই পালানোর নাটক শুরু হয়।বিজয়নগর, কাকরাইল,শাহবাগ হয়ে ফার্মগেইট পেরিয়ে তারা পশ্চিম আগারগাঁওয়ে বোনের বাসায় পৌঁছায়।সেখানে গিয়ে অস্ত্রভর্তি ব্যাগ ফেলে দেওয়া,মোবাইল ছাদে ছুড়ে ফেলা এবং নকল নম্বরপ্লেট বদলানোর মতো একের পর এক আলামত নষ্টের চেষ্টা চলে।এতে পরিবারের সদস্যরাও জড়িয়ে পড়ে।

বিকেল ৪টা ৫৪ মিনিটে সিএনজিতে করে আমিনবাজার হয়ে ধামরাই,নবীনগর ও গাজীপুরের চন্দ্রা-মাওনা পেরিয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছায় ফয়সাল।রাত ১১টা ৩১ মিনিটে হালুয়াঘাটের ধারাবাজার পেট্রোল পাম্পে পৌঁছানোর সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে।সেখান থেকে মানবপাচারকারী ফিলিপ স্নালের সহায়তায় সীমান্ত পেরিয়ে তারা ভারতে পালিয়ে যায় বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

ফয়সালের ফোনের আইপি অ্যাড্রেস বিশ্লেষণে দেখা যায়, হত্যার পরদিন তার লোকেশন ছিল ভারতের মহারাষ্ট্রে এবং তিনি রিলায়েন্স সিম ব্যবহার করছিলেন।

তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য

হত্যায় সহায়তার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে শ্যালক শিপু,স্ত্রী সামিয়া ও বান্ধবী মারিয়াকে।কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেফতার বাবা-মায়ের তথ্যের ভিত্তিতে নরসিংদীর তারাবো বিল থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি অস্ত্র।গ্রেফতার হন প্রাইভেটকারচালক নুরুজ্জামানও।

ডিএমপির মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান,ঘটনার আগে ও পরে প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সাল পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন।সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্তে কাজ চলছে।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে,ফয়সাল কবির,কামাল,রুবেল ও মাইনুদ্দিনদের নিয়ে একটি কিলিং মিশন গড়ে তুলেছিলেন। তারা সবাই কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা বলে তদন্তে উল্লেখ রয়েছে।

হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি অল্প সময়ের মধ্যে আটবার হাতবদল হয়।নকল নম্বরপ্লেট ব্যবহার করা হয়েছিল। সিটিটিসির অভিযানে মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়েছে।

এছাড়া উদ্ধার হওয়া কয়েকশ কোটি টাকার চেক তদন্তে নতুন প্রশ্ন তুলেছে—এই বিপুল অর্থ কি কেবল হাদিকে হত্যার জন্য, নাকি আরও বড় কিলিং মিশনের পরিকল্পনা ছিল?

আরও খবর

Sponsered content