প্রতিনিধি ৬ মার্চ ২০২৩ , ৩:১৩:০৯ প্রিন্ট সংস্করণ
উখিয়া(কক্সবাজার)প্রতিনিধি।।কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১১) পাহাড়ি ঢালুর রোহিঙ্গা বসতির ডি ব্লক এলাকা।গতকাল রোববার বিকেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এই ব্লকের অন্তত ৭০০ রোহিঙ্গা বসতি (ত্রিপলের ছাউনির ঘর) পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।গৃহহীন কয়েক শ রোহিঙ্গা পরিবার রাতে অবস্থান নেয় ধ্বংসস্তূপের পাশে খোলা জায়গায়।কিছু রোহিঙ্গা পাশের আরেকটি পাহাড়ের রোহিঙ্গা বসতিতে আশ্রয় নিয়েছে।কিছু রোহিঙ্গার ঠাঁই হয়েছে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে একটি ট্রানজিট কেন্দ্রে।

একই সময় আগুনে পুড়ে গেছে ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরের এ ও বি ব্লকের আরও ১ হাজার ৪০০টির বেশি রোহিঙ্গা বসতি। এই দুই ব্লকের অধিকাংশ রোহিঙ্গাও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে।
আজ সোমবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে,গৃহহীন পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপ দেখতে ছুটে আসে আশপাশের আশ্রয়শিবিরের শত শত রোহিঙ্গা।কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপ থেকে পুড়ে যাওয়া মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন।কেউ নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র,আসবাব খুঁজছেন।কেউ কেউ নিজের ঘরের অবস্থান চিহ্নিত করে খুঁটি পুঁতে রাখছেন।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে,ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন ৩২ হাজার ২০০ জন।ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শেল্টার (বসতি) পুড়েছে।ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি।৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র,লার্নিং সেন্টার,ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।
গৃহহীন কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান,গত রাতটি তাঁদের নির্ঘুম কেটেছে।অনেকের পেটে খাবার জোটেনি।সেখানে খাবার ও পানীয় জলের তীব্র সংকট চলছে।
ধ্বংসস্তূপের কিছুটা দূরে (দক্ষিণে) ত্রিপলের ছাউনি টানিয়ে অবস্থান করছেন রোহিঙ্গা নারী সাবেকুন্নাহার।সঙ্গে তিন ছেলে-মেয়ে।সাবেকুন্নাহার (৩৮) বলেন,গতকাল বিকেল চারটার দিকে তাঁর শেল্টারে আগুন ধরে।এ সময় পরিবারের সবাই প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে ঘর ছাড়েন।চার-পাঁচ মিনিটের মাথায় তাঁর ঘরে আগুনে ধরে এবং সবকিছু পুড়ে ছাই হয়। রাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত কারও পেটে খাবার জোটেনি।
ধ্বংসস্তূপের পশ্চিম কোনায় খোলা জায়গায় চার সন্তান নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন সখিনা বেগম।তাঁর স্বামী নবী হোসেন ধ্বংসস্তূপ থেকে পুড়ে যাওয়া গৃহসামগ্রী তুলে আনছেন।সখিনা বেগম (৪৪) বলেন,সবকিছু চোখের সামনে শেষ হলো। গভীর রাত পর্যন্ত কেউ ধ্বংসস্তূপের দিকে যেতে পারেননি। কারণ,কিছুক্ষণ পরপর গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটছিল। রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত থাকে।জ্বালানি কাঠের বিকল্প হিসেবে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারে দেড় থেকে দুই বছর ধরে গ্যাস সিল্ডিন্ডার সরবরাহ করছে জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা।
আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা কামাল হোসেন,মরিয়ম বেগম ও রহিম উল্লাহ জানান,বেলা পৌনে ৩টার দিকে আশ্রয়শিবিরের এ,ডি ও বি ব্লকের তিনটি পৃথক জায়গাতে একসঙ্গে আগুন জ্বলতে দেখেন তাঁরা।প্রচণ্ড গরম ও উত্তর দিক থেকে ছুটে আসা বাতাসে মুহূর্তে ওই আগুন অন্যান্য বসতিতে ছড়িয়ে পড়ে।শেল্টারগুলো একটার সঙ্গে একটা লাগানো ও ঘনবসতি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ছে রোহিঙ্গা বসতি। রোববার বিকেলে
সেনাবাহিনী, পুলিশ, এপিবিএন, ফায়ার সার্ভিসসহ কয়েক শ স্বেচ্ছাসেবী সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও সকাল ছয়টার আগে লোকজন ধ্বংসস্তূপের দিকে যেতে সাহস পাননি।গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আতঙ্ক এখনো রয়েছে। গৃহহীন পরিবারে দ্রুত খাবার ও পানীয় জল সরবরাহের দাবি ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গার জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাঁরা মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) সন্দেহ করছেন।আগুনে পুড়ে যাওয়া কিছু বসতিতে মিয়ানমারের আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) কিছু সদস্য অবস্থান নেন।তাঁদের উৎখাত (নিশ্চিহ্ন) করতেই পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পে আগুন দেয় আরসা।এ অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে গত ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের যোগসূত্র খুঁজছেন রোহিঙ্গারা।আরএসও ও আরসার মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের পর শূন্যরেখার ওই আশ্রয়শিবিরটির ৬৩০টির বেশি শেল্টার আগুনে পুড়ে যায়।তাতে চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়েছিল।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন,ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়েছে।রাতেই গৃহহীন প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গাকে শিবিরের অভ্যন্তরে ট্রানজিট কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে।ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে শুকনা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। আজ সোমবার দুপুরে তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে।দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া হবে।
দুই বছর আগে, অর্থাৎ ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীর তিনটি আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮, ৯ ও ১১) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়েছিল।গৃহহীন হয়েছিল ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা।অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যায় ৬ শিশুসহ ১৫ রোহিঙ্গা।অবশ্য এবারের অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ।এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন ৮ লাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গাদের নেতারা বলছেন,বালুখালী আশ্রয়শিবিরে দুই মাস ধরে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর (আরসা ও আরএসও) মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।তাতে ১০ থেকে ১২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরের একাধিক স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।এটা রহস্যজনক।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন,আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান।আজ থেকে কমিটি তদন্ত শুরু করবে এবং তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

















