সারাদেশ

বরিশাল-সিটি-ছাত্রলীগে-শ্রমিকনেতা-বিবাহিত-ও-বয়সোত্তীর্ণরা নতুন কমিটির প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও সমাবেশ!!!

  প্রতিনিধি ২৫ জুলাই ২০২২ , ১১:০৯:১২ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:-বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন কমিটি করা হয়নি, এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।

দীর্ঘ ১১ বছর পর বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এই কমিটি অনুমোদন করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ঘোষিত এই কমিটি নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

ব‌রিশাল সদর আসনের সাংসদ ও পা‌নি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জা‌হিদ ফারুখ শামীমের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মহানগর ছাত্রলীগের ঘো‌ষিত ক‌মি‌টি বাতিল করে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ক‌মি‌টি গঠনের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেছে সোমবার দুপুরে।

পদব‌ঞ্চিত ছাত্রলীগ কর্মী রেজাউর রহমান নিয়ন বলেন, ‘একজন শ্রমিক নেতাকে কি করে ছাত্রলীগের দা‌য়িত্ব দেয়া হয়? মহানগর ছাত্রলীগে যাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে সেই মান্না দুই সন্তানের জনক। তার বড় সন্তানের বয়স প্রায় ১০ বছর। যুগ্ম আহ্বায়ক মাইনুল ইসলাম ও আ‌রিফুর রহমান শা‌কিলও বিবা‌হিত। ব‌রিশালে জমকালো আয়োজনে তাদের বিয়ে হয়েছে। ছাত্রত্ব ও বয়স নেই তিনজনেরই। এ ছাড়াও যাদের সদস‌্য করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের ব্যাকগ্রাউন্ড বিএন‌পি‌।’

মান্না এক তা‌লিকাভুক্ত সন্ত্রাসী দাবি করে নিয়ন বলেন, ‘এসব লোককে ক‌মি‌টিতে এনে ছাত্রলীগকে কলু‌ষিত করা হয়েছে।’

তান‌ভির আহসান নামে সংসদ সদস‌্য জা‌হিদ ফারুখ শামীমের অনুসারী আরেক কর্মী বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপ‌তি আল না‌হিয়ান খান জয় বরিশালের রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চাইছেন অনেকদিন ধরেই। এজন‌্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপ‌তি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সি‌টি মেয়র সের‌নিয়াবাত সা‌দিক আব্দুল্লাহর ছত্রছায়া প্রয়োজন। তাই তাদের নির্দেশনায় কমিটি দিয়েছেন জয়।’

তানভির মনে করেন, ব্যক্তি স্বার্থে সংগঠনের নাম খারাপ করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল না‌হিয়ান খান জয়।

বরিশাল ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইজ আহম্মেদ মান্না চলতি মাসে গঠিত বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ঐক‌্য ফেডারেশনের আইন বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক ফেডারেশনের সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদেও আছেন। পাশাপাশি বরিশাল জেলা বাসমালিক গ্রুপের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস‌্যও তিনি।

জানা গেছে, বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের অঘোষিত নিয়ন্ত্রকও মান্না। কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম‌্যান কামাল হোসেন মোল্লা লিটন বাস টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন বিএমএফ পরিবহনের কাউন্টার দখলের মাধ‌্যমে। তবে লিটনকে সরিয়ে জেলা বাসমালিক গ্রুপের মাধ‌্যমে বিএমএফ কাউন্টারের নিয়ন্ত্রণ নেন মান্না।

প্রথমে অভ‌্যন্তরীণ রুটের একটি বাস কিনে পরিবহন ব‌্যবসায় প্রবেশ করেন মান্না। পরে ধীরে ধীরে শ্রমিকনেতা হওয়ার চেষ্টা করেন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় মিলে যায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের পদও।

সূত্রটি আরও জানায়, বরিশাল সিটি করপোরেশনের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী মান্না বিয়ে করেছেন প্রায় একযুগ আগে। তার সন্তানও রয়েছে।

এদিকে যুগ্ম আহ্বায়ক মাইনুল ইসলাম ও আরিফুর রহমান শাকিলও বিবাহিত। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কমিটিতে আসার বয়সও নেই তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের এক সহসভাপতি বলেন, ‘কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই ধরনের কমিটির ঘোষণায় কেন্দ্রীয় কমিটির ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বরিশালের বাসিন্দা হওয়ায় মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সুপারিশ অনুযায়ী তিনি কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫ এর গ ধারায় বলা আছে- কোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী (৫ এর ক উপধারা অনুযায়ী) ছাত্রলীগের কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হতে পারে। বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত ছাত্রছাত্রী ছাত্রলীগের কর্মকর্তা হতে পারবে না। তবে গঠনতন্ত্রের এই ধারা মহানগর ছাত্রলীগের ওই তিন নেতার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। এ ছাড়া ২৭ বছরের ওপরে কোনো ব্যক্তি কমিটির পদ-পদবি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই ওই তিনজনেরও পদ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

জেলা ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী জানান, সদ্য ঘোষিত মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মান্না গত ১৮ আগস্ট বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলার মামলায় অন্যতম আসামি ছিলেন। এ ছাড়া বিসিক এলাকায় ব‌্যবসায়ীদের ওপর হামলার মামলায়ও তিনি আসামি। আত্মরক্ষার জন্য তিনি একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পরিচয়পত্রও বহন করেন। ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মান্নার বর্তমান বয়স ৩২ বছর।

এ ছাড়া এক বছর আগে বিয়ে করা এবং ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যুগ্ম আহ্বায়ক মাইনুল ইসলামের বর্তমান বয়স ৩০ বছর। অপর যুগ্ম আহবায়ক আরিফুর রহমান শাকিল বিয়ে করেছেন চলতি বছরের ৩১ জানুযারি। তার বয়সও ত্রিশের কাছাকাছি।

সদ্য ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মেরও অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা ছাত্রলীগের আরেক সহ-সভাপতি বলেন, ‘যাদের কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে তারা সবাই সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তিনি যা সুপারিশ করেছেন সেই অনুযায়ী আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়নি।’

এসব বিষয় নিয়ে সদ্য ঘোষিত বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘মহানগর ছাত্রলীগে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। এই কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে কিছু নেতাকর্মী অন্তত পরিচয় বহন করতে পারবে। আমি বিবাহিত কি না তা মূল বিষয় না। মহানগর ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করতে আমার নেতা সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ যা ভালো মনে করছেন তাই করছেন। টেন্ডারবাজ ও শিক্ষকদের মারধর করা ব‌্যক্তিদের নিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি করলে সম্ভবত আপনারা খুশি হতেন।’

আহ্বায়ক রইজ আহমেদ মান্না বলেন, ‘ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য একটি সম্মেলন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ যাদের যোগ্য মনে করেছেন তাদের জন্য সুপারিশ করেছেন। এই কমিটিকে এক প্রকার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি বলা যায়। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় নেতাকর্মীরা পরিচয়হীন ছিল। তিন মাস মেয়াদি এই কমিটির মধ্য দিয়ে হলেও কিছু নেতাকর্মী তাদের পরিচয় পেয়েছে।’

এদিকে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনে রইজ আহম্মেদ মান্নার পদপ্রাপ্ত হওয়ার প্রমাণাদি রয়েছে। এ ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক মাইনুল ইসলামের বিয়ের ছবিও রয়েছে। পাশাপাশি যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান শাকিলের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি যে বিবাহিত তা উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ও বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা তানভির হাসান সৈকত বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়েছে। তা ছাড়া যেখানে আল নাহিয়ান খান জয় ভাই নিজে দায়িত্ব নিয়ে কমিটি করেছেন, সেখানে আমাদের যাচাই-বাছাই করারও প্রয়োজন নেই। জয় ভাইয়ের বাসাও কিন্তু মহানগরেই। তবুও লিখিত অভিযোগ পেলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।’

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি বলেন, ‘যদি কোনো ব‌্যক্তি শ্রমিক সংগঠনের পদধারী নেতা হয়ে থাকেন তাহলে তার ছাত্রলীগের কমিটিতে আসার সুযোগ নেই। বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটির অনুমোদন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়েই করা হয়েছে। আমরাও যাচাই-বাছাই করেছি। আমাদের যাচাই-বাছাইতে ত্রুটি থাকতে পারে। যে কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেই কমিটি নিয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ আসলে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথে কথা বলে সাংগঠনিক ব‌্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন কমিটি গঠন করা হয়নি, এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা ফোন কল রিসিভ করেননি।

শনিবার রাতে বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সামনে নবগঠিত মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিতে পদপ্রাপ্তদের উদ্দেশে ফেসবুক লাইভে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি দীর্ঘ বছর না থাকায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। যারা অভিজ্ঞ রয়েছেন তাদের নিয়ে করা খসড়া কমিটি আমার সুপারিশে অনুমোদন হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে তোমরা ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সম্মেলন শেষ করে মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলনের আয়োজন করবা। অনেকে অনেক কথা বলবে সেগুলো মাথায় নেয়া যাবে না।’

১১ বছর পর মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ায় রোববার বিকালে বরিশাল নগরীতে আনন্দ মিছিলও করেছেন মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে তিন সদস্যবিশিষ্ট বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে সাংগঠনিক সম্পাদক তৌসিক আহম্মেদ রাহাত চাকরির সুবাদে ছাত্ররাজনীতি থেকে বিদায় নেয়। এরপর ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানকে বহিষ্কার ও ২০২১ সালের ২৫ মে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের দায়ে সভাপতি জসীম উদ্দিনকে অব‌্যাহতি দিয়ে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

আরও খবর

Sponsered content