প্রতিনিধি ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১:৩০:৪৮ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।সুন্দরী মেয়েটার হাতে যখন একশো টাকার কড়কড়ে নোটটা দিলাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ষাটোর্ধ্ব লোকটার চোখেমুখে তখন হতাশার চিত্র ফুটে উঠলো। কারণ, একটু আগেই উনি সিলভারের পুরনো একটি থালা হাতে আমার কাছে আল্লাহর ওয়াস্তে দুই টাকা ভিক্ষা চাইলে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিই।
চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় লোকটা আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি এবার দ্রুত পা চালালাম। কলেজ গেট পেরিয়ে হাসপাতালের দিকে চলে যাওয়া সরু গলিটা ধরে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। রাস্তার পাশে বেঞ্চে একটু জিরিয়ে নিতে মন চাইলো। হাসপাতালের আশেপাশে এমন অনেকগুলো বেঞ্চ রয়েছে বসার। দু’টো বাচ্চা বসে আছে। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান। আমি ধমকের স্বরে বললাম, এই! সরে বস তোরা। বাচ্চা দু’টো কাচুমাচু হয়ে একপাশে চেপে বসলো। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট টানতে লাগলাম।
একটা শেষ হবার পর আরেকটা ধরালাম। আশেপাশে খেয়াল নেই কোনো। হঠাৎ একটা বাইক এসে সামনে থামলো। চেয়ারম্যানের বড় ছেলে। পেছনে তার স্ত্রী। আর দু’জনের মাঝখানে ছেলেটা বসা। বয়স চার সাড়ে চার হবে। আমি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শফিক ভাই বললো, আরে রিয়াদ যে, একটা কাজ কর। শামীমকে তোর কাছে একটু রাখ। আমি তোর ভাবীকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসছি। গাইনি ডাক্তার। কিছুক্ষণ পরই নাকি চলে যাবে। শফিক ভাইয়ের কথা শুনে তড়িঘড়ি করে সিগারেটটা মাটিতে ফেলে জুতোর নিচে পিষে দিলাম। এরপর শামীমকে এনে বেঞ্চে বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। শফিক ভাই চলে গেলো। লক্ষ্য করলাম বাচ্চা দুটো ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কে জানে, হয়তো মনে মনে কিছু বলছেও।
সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। বাইক এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছি। হাতে পায়ে আঘাত পাওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত লাগবে। পরিবারের সদস্যরা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে রক্তের জন্য। কিন্তু আমার ব্লাডের সাথে ম্যাচ করে এমন কাউকে পাচ্ছে না। পেলেও রক্ত দেয়ার মতো উপযোগী নয়। বেশ কিছুক্ষণ পর একজনকে পাওয়া গেলো। তারও নাকি রোগী আছে মহিলা ওয়ার্ডে। একবার চোখের দেখা উনাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। চেনা নেই জানা নেই আমাকে উনি রক্ত দিলেন।
মাস খানেক পরের ঘটনা। একটা কাপড়ের দোকানে ঐ লোকের সাথে দেখা হলো, যিনি আমায় রক্ত দিয়েছিলেন। কুশল বিনিময়ের সময় খেয়াল করলাম তার পেছনে গাঁ ঘেঁষে দু’টো বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। ঐ বাচ্চা দু’টোই। হাসপাতালের পাশে বেঞ্চে যাদের আমি ধমক দিয়েছিলাম। আর পাশে বসে সিগারেটও খেয়েছিলাম৷ লোকটাকে ওদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবো তখনি ওদের একজন তাকে ‘আব্বা’ বলে ডেকে উঠলো। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না ওদের সাথে কোন ভাষায় আর কী করে কথা বলবো। আমি যতোই আদর আপ্যায়নের চেষ্টা করিনা কেনো, ওদের চোখে আমি তো অমানুষ বৈ কিছু নই।
পরদিন ঐ ভিক্ষুকের সাথে দেখা। সব ভিক্ষুক এক নয়। কিছু মানুষ এমন আছে যাঁরা সত্যিকারার্থেই অপারগতার কারণে ভিক্ষা করেন। কিন্তু তাঁদের আত্মসম্মান আছে। উনিও হয়তো তাঁদেরই একজন। না হয় আমাকে দেখে তড়িঘড়ি করে পাশ কেটে চলে যেতো না। দুপুরের প্রখর রোদে ছাতা নিয়ে বাজারের মেইন রোড ধরে হাঁটছি। হাঁটছি আর ভাবছি, এই-যে কতো শতো মানুষ। ওরাও মানুষ আর আমিও। বাকিরা কে কেমন তা তো জানিনা। কিন্তু আমি যে অমানুষ তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।