প্রতিনিধি ২৫ আগস্ট ২০২৪ , ২:৩১:২১ প্রিন্ট সংস্করণ
বিজয় প্রসাদ।।বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পরদিন আমার এক বন্ধুর ফোনকল পেয়েছিলাম।বন্ধুটি সেদিন ঢাকার রাস্তায় বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন।তিনি আমাকে বলেছিলেন,কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা বিশাল বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল।আমি তাঁকে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কাঠামো ও তাদের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি।তিনি তখন বলেন,বিক্ষোভটি সুসংগঠিত বলেই মনে হয়েছে।ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু করলেও তা শেষ পর্যন্ত সরকারের পদত্যাগের দাবি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল।তবে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও মনে হয়নি,সরকারের পতন হতে পারে।সবাই ভেবেছিল,সরকার আরও সহিংস হবে।
বাংলাদেশে এই বিক্ষোভ একেবারে আকস্মিক নয়।এটি মূলত এক দশক আগে শুরু হওয়া ক্ষোভের চক্রের একটি অংশ। দাবিগুলোও বেশ পুরোনো।যেমন কোটা সংস্কার করা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা,সরকারি দমন-পীড়ন বন্ধ করা ইত্যাদি।আপাত সরল এই দাবিগুলো হয়তো সহজেই সমাধান করা যেত।কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিগুলো দেশের অভিজাত শ্রেণি সব সময় মরিয়া হয়ে দমন করার চেষ্টা করেছে।এই কোটার সঙ্গে দেশের জন্মের ইতিহাস জড়িত। কারণ সিংহভাগ কোটা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ ছিল,যারা ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। অনেকে জীবন দিয়েছেন,অনেকে অঙ্গ-প্রতঙ্গ হারিয়েছেন।
তবে এটিও স্বীকার করতে হবে যে,এ ধরনের কোটা ব্যবস্থা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহাল রাখা উচিত নয়।একই সঙ্গে এটিও স্বীকার করতে হবে যে,কোটা ব্যবস্থার সঙ্গে দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের সমস্যা এবং দেশে ইসলামপন্থী শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি জড়িত।স্মরণ করা কর্তব্য,বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আপস করেছিল।
যা হোক,২০১৮ সালে একবার কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা এই কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছিলেন।এরপর কোটা ব্যবস্থা বহাল থাকবে কি থাকবে না,চলতি বছরে তার সিদ্ধান্ত চলে যায় আদালতে।হাইকোর্ট যুক্তি দেন,কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। কিন্তু পরে জুন মাসে, সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন,কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে পুনর্বহাল করা যাবে না,আংশিকভাবে করতে হবে।এই রায়ের পর আন্দোলন নতুন রূপ পায়।আন্দোলনকারীরা শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে আন্দোলন শুরু করে।
আজ থেকে এক দশক আগেও ঢাকার শাহবাগ চত্বরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নানা অভিযোগে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।আদালতের সেই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শাহবাগ চত্বরে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
যা হোক,এ ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের শেষ পরিণতি অনুমান করা যায় না।যেমন আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনার বিদায়ের আগে পর্যন্ত তা অনুমান করা যায়নি।তবে সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভের সঙ্গে ২০১১ সালের কায়রো বিক্ষোভের মিল রয়েছে।ওই বিক্ষোভের জেরে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করে সৌদি আরবে পালিয়ে যান।
কায়রো থেকে ঢাকা
হোসনি মোবারক কায়রো ত্যাগ করার পর মিশরের দায়িত্ব নেয় দেশটির সেনাবাহিনী।কিন্তু কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যারা বিক্ষোভ করেছিল,তারা চেয়েছিল, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এল বারাদি মিশরের দায়িত্ব নিন।এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী একটি সংবিধান সভা আহ্বান করতে ২০১২ সালে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়।ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে মিশরের সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড।এর এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালে ব্রাদারহুড সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী। তারা এল বারাদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু তিনিও মাত্র জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত ওই পদে থাকতে পেরেছিলেন।
ওই সময়কালে মিশরের সামরিক বাহিনী সংবিধান স্থগিত করে এবং সেনাপ্রধান নিজের উর্দি খুলে সাধারণ স্যুট পরে নিজেই প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন।সেই উর্দি খোলা জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মিশরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় রয়েছেন।তিনি তাহরির স্কয়ারে আন্দোলনকারী বেশির ভাগ নেতাকেই কারাবন্দী করেছেন।আন্দোলনকারী ওই প্রজন্ম এখন ভীষণ হতাশ।
বাংলাদেশে এল বারাদি হলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।তিনি এরই মধ্যে সাবেক আমলা,শিক্ষাবিদ ও এনজিও খাতের উদারপন্থী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকার গঠন করেছেন।অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।নয়া উদারতাবাদী অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের ব্যাপারে তাঁর বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে।তিনি বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও মিশরের নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী আহমেদ কাউচউকের সঙ্গে বৈঠক ও অলোচনায় নিঃসন্দেহে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখনো ব্যারাকেই রয়েছে।কিন্তু দমন-পীড়নের সংস্কৃতি পাল্টায়নি,শুধু গ্রেপ্তারের ঠিকানা পাল্টেছে। ইউনূসের সরকার বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও অন্যান্য নেতাদের বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার করছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রতিদিন বিভিন্ন অভিযোগে নতুন নতুন গ্রেপ্তারের খবর আসছে।শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ধ্বংসপ্রায়।তিনি নিজে কূটনৈতিক পাসপোর্টে ভ্রমণের অধিকার হারিয়েছেন।হত্যার অভিযোগ এনে সম্প্রতি ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এমনকি আওয়ামী লীগের এমপি ও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান,যিনি এখন পাকিস্তানে বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছেন,তাঁর বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা করা হয়েছে।
এসব মামলা শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না,সেটি দেখার বিষয়। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে,শুধু প্রতিশোধের উদ্দেশ্যেই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট দলের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুত্থান দেখা যাচ্ছে।জামায়াতেরই আরেক শাখা ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি–(এবি পার্টি)’ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এই পার্টির বেশ কয়েকজন নেতাকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
ফলে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে,বাংলা বসন্ত খুব দ্রুতই শীতের দিকে যাচ্ছে।
লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ,সম্পাদক এবং সাংবাদিক। তিনি গ্লোবট্রটার–এর রাইটিং ফেলো এবং প্রধান সংবাদদাতা। একই সঙ্গে তিনি লেফট ওয়ার্ড বুকস–এর সম্পাদক এবং ট্রাইকন্টিনেন্টাল: ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চের পরিচালক।
-নিবন্ধটি পিপলস ডিসপ্যাচ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত এবং সংক্ষেপিত।